Skip to main content

বাগেরহাট: এক হারানো শহরের আখ্যান





Photo: durbarbagerhat


বাগেরহাট- হযরত খান জাহান আলী (র) এর স্মৃতিবিজড়িত শহর। কারো কারো কাছে ষাট গম্বুজ মসজিদের শহরও বটে। কারণ এই জেলার নাম শুনলেই যে ষাট গম্বুজ মসজিদের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। কিন্তু বাগেরহাট শহরের পরিচয় কি কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ? মোটেই না।বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন "15 Lost Cities of the World" শীর্ষক একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেখানে মাচু পিচু, ইৎজা, মেম্ফিস, বেবিলন, পম্পেই কিংবা ট্রয়ের মতো প্রাচীন কিংবদন্তীর শহরের পাশাপাশি জায়গা পেয়েছিল আরো একটি শহর: মসজিদের শহর বাগেরহাট।







হ্যাঁ, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা শহর বাগেরহাটের কথাই বলা হয়েছে সেখানে। অনেকের কাছেই অদ্ভূত লাগতে পারে। কারণ বাগেরহাট হারানো শহর কই, এখনো তো দিব্যি সেখানে বিপুল জনবসতি রয়েছে! মূলত তালিকার অন্যান্য শহরের সাথে বাগেরহাটের পার্থক্যটা ঠিক এখানেই। অন্যান্য 'হারানো শহর' উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও কেবল দর্শনীয় স্থানেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অথচ বাগেরহাট এখন আগের চেয়েও প্রাণবন্ত একটি শহর। অবশ্য প্রাচীন খলিফাতাবাদের অনেক নিদর্শনই এখনো মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে, যেগুলো উদ্ধারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।তালিকার অন্যান্য শহরের সাথে বাগেরহাটের আরো একটি বড় পার্থক্য হলো, বাগেরহাট সময়ের বিচারে খুব প্রাচীন কোনো শহর নয়। গোটা বিশ্বের সাথে তুলনায় কেন, শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এটি কিন্তু খুব প্রাচীন কোনো শহর নয়। যেমনটি পর্যটন বিশেষজ্ঞ টিম স্টিল বলেন:"বাংলাদেশের মাটি থেকে ধীরে ধীরে বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া, অনন্য, সম্ভাব্য তাৎপর্যপূর্ণ শহর বেরিয়ে আসছে: ওয়ারী বটেশ্বর, ভিটাগড় এবং এগারোসিন্দুর যাদের মধ্যে সবচেয়ে কম অনুমিত। তবে এদের কোনোটিই, এখন পর্যন্ত, বাগেরহাটের সমপর্যায়ের সমৃদ্ধ ইতিহাসের বাস্তব প্রমাণ দিতে পারেনি। অথচ আবারো, আজ যে বাগেরহাট আমরা দেখি সেটির দৃশ্যমান ইতিহাসও কিন্তু মাত্র ছয় শতকের, যেখানে অন্যান্য স্থানের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, এবং আরো পুরনো ইতিহাসও হয়তো বের হওয়া বাকি। তারপরও সেগুলোর পক্ষে নিশ্চিতভাবেই কখনো এই সুন্দর, প্রাচীন, এবং আধুনিক মসজিদের শহরের মতো দৃষ্টিগ্রাহ্য ও বাস্তব আবেদন সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।"




কোন সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা বলছেন তিনি? ষাট গম্বুজ মসজিদ কিংবা খান জাহান আলী (র)-এর মাজার তো রয়েছেই, কিন্তু ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ওয়েবসাইট অনুযায়ী বাগেরহাটের সমৃদ্ধির তালিকাটা আরো লম্বা। তাদের মতে, ৫০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই 'মহৎ শহরে' রয়েছে ৩৬০টি মসজিদ, গণভবন, সমাধিস্তম্ভ, সেতু, রাস্তা, দিঘী এবং আরো নানা স্থাপত্য, যেগুলো নির্মিত হয়েছে টেরাকোটা দিয়ে। এছাড়াও ভুলে গেলে চলবে না, শহরটিতে এখনো রয়েছে অন্তত ৫০টি নিদর্শন, যেগুলো সাক্ষ্য বহন করছে বঙ্গীয়-সুলতানি ঘরানার ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর।
অনেকেরই ধারণা, কেবল ষাট গম্বুজ মসজিদই বুঝি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান। কিন্তু আদতে খান জাহান আলী (র)-এর আমলে তার দ্বারা নির্মিত পুরো শহরটিকেই ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসাবে তালিকাভুক্ত করে (১৯৮৩ সালে স্বীকৃতি)।






বাগেরহাটের নাম কেন বাগেরহাট হলো, এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কেউ বলেন, বাগেরহাটের নিকটবর্তী সুন্দরবন থাকায় এলাকাটিতে বাঘের উপদ্রব ছিল, এ জন্যে এ এলাকার নাম 'বাঘেরহাট' হয়েছিল, এবং ক্রমান্বয়ে তা 'বাগেরহাট'-এ রূপান্তরিত হয়েছে। আবার অন্য অনেকের বিশ্বাস, হযরত খানজাহান আলী (র) এর প্রতিষ্ঠিত 'খলিফাত-ই-আবাদ' (খলিফাতাবাদ) এর বিখ্যাত 'বাগ' অর্থ বাগান এ অঞ্চলে এতই সমৃদ্ধি লাভ করে যে, তা থেকেই অঞ্চলটির নাম দাঁড়িয়েছে বাগের আবাদ তথা 'বাগেরহাট'।

অবশ্য লোকমুখে যে ব্যাখ্যাটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য তা হলো- বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদীর উত্তর দিকের হাড়িখালী থেকে বর্তমান নাগের বাজার পর্যন্ত যে লম্বা বাঁক বিদ্যমান, পূর্বে সে বাঁকের পুরাতন বাজার এলাকায় একটি হাট বসত। আর এ হাটের নামে এ স্থানটির নাম হয়েছিল 'বাঁকেরহাট'। কালক্রমে 'বাঁকেরহাট' পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে 'বাগেরহাট' নামে।







বাগেরহাটের গোড়াপত্তন ঘটে অবশ্যই খান জাহান আলী (র)-এর হাত ধরে, যার নাম ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছি। পূর্বপুরুষগণ তুরস্কের অধিবাসী হলেও, ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন দিল্লিতে, এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ১৩৮৯ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে, একজন সেনাপতি হিসেবে।


কবে নাগাদ খান জাহান আলী (র) দক্ষিণবঙ্গে এসেছিলেন, সে ব্যাপারে সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এটুকু মোটামুটি বলা যায় যে তিনি যখন বঙ্গে আসেন, তখন গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ। আর তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুটি: ইসলাম ধর্ম প্রচার ও রাজ্য প্রতিষ্ঠা।

এ সময় দক্ষিণবঙ্গে আগমনের একমাত্র পথ ছিল ভৈরব নদী। খান জাহান আলী (র) গৌড় হতে পদ্মা নদী ধরে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের নিকটবর্তী ভৈরব নদীতে আসেন। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ হয়ে তিনি যশোরের বারোবাজারে উপনীত হন। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন তিনি। ১১ জন আউলিয়া নিয়ে তিনি যশোরের বারোবাজারে কিছুকাল অবস্থান করেন। এখান থেকেই তার দক্ষিণবঙ্গ জয়ের সূচনা।

বারোবাজারে কিছুকাল অবস্থান করার পর খান জাহান আলী (র) চলে যান মুরলী, যেখানে বর্তমান আধুনিক যশোর শহর। মুরলী থেকে তার প্রচার-বাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়। একদল সোজা দক্ষিণ মুখে কপোতাক্ষের পূর্ব ধার দিয়ে ক্রমে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, অন্যদল পূর্ব-দক্ষিণ মুখে ক্রমে ভৈরবের কূল দিয়ে পায়গ্রাম কসবায় গিয়ে পৌঁছায়। এই দলেরই নেতৃত্বে ছিলেন খান জাহান আলী (র) নিজে।








পায়গ্রাম কসবায় অল্প কিছুদিন অবস্থানের পর ভৈরবের তীর ধরে সুন্দরঘোনা পৌঁছান তারা। এই স্থানে এক নতুন শহরের পত্তন করেন তিনি, নাম দেন খলিফাতাবাদ। এরই বর্তমান নাম বাগেরহাট।

খান জাহান আলী (র) যখন খলিফাতাবাদে এসে পৌঁছান, তখন এখানকার বেশিরভাগ জায়গাই ছিল বনাঞ্চল। তিনিই তার অনুসারীদের নিয়ে বন-জঙ্গল সাফ করেন, এবং এ অঞ্চলকে পুরোপুরি বসবাসের উপযুক্ত করে তোলেন। খলিফাতাবাদসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চল একপ্রকার তারই রাজ্য ছিল। কোনো বাধা ছাড়াই এই এলাকা তিনি শাসন করতে থাকেন।

খান জাহান আলী (র) প্রথম যে স্থানে এসে সৈন্যাবাস স্থাপন করেছিলেন, ওই এলাকার নাম তিনি রাখেন বারাকপুর। এখানেই তিনি তার প্রথম দীঘি খনন করেন। এই দীঘির নাম ঘোড়া দীঘি। কথিত আছে, একটি ঘোড়া যতদূর দৌড়ে গিয়েছিল, তত দীর্ঘ করে এই দীঘি খনন করা হয়। তৎকালীন সময়ে এই দীঘির পরিমাণ ছিল ১০০০ × ৬০০ হাত।

ঘোড়া দীঘি পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ, এবং এই দীঘিরই পূর্ব পাশে অবস্থিত সুবিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ। বিশাল এ মসজিদে আলো-বাতাসের কোনো অভাব হয় না। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে ৬টি করে ছোট ও একটি করে বড় খিলান। পূর্বপাশে একটি বড় ও তার দু'পাশে ৫টি করে ছোট খিলান। দৈর্ঘ্যে ১৬৮ ফুট ও প্রস্থে ১০৮ ফুটের এ মসজিদের দেয়ালগুলো আট ফুট করে চওড়া।




মসজিদের পূর্বদিকের দুটি মিনারের মধ্যে ঘোরানো সিঁড়ি আছে, এবং ওই দুটি পেছনের দিকের দুটি মিনার অপেক্ষা উঁচু। মিনার দুটির একটির নাম রোসন কোঠা বা আলোক ঘর, অন্যটির নাম আঁধার কোঠা। মুয়াজ্জিন এই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজের পূর্বে আজান দিতেন। মসজিদটিতে সাত সারির ২১টি কাতারে একসঙ্গে প্রায় তিন হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা সংরক্ষিত জায়গা।

খান জাহান আলী (র)-এর আমলে ষাট গম্বুজ মসজিদ দুটি উদ্দেশ্য পূরণ করত। বিরাট এই মসজিদে নামাজ আদায় তো একটি উদ্দেশ্য ছিলই, এছাড়া এটি ছিল শাসনকর্তা খান জাহান আলী (র)-এর প্রধান দরবারগৃহ। এখানে সকাল থেকে রীতিমতো দরবার বসত, সমবেত প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ, তাদের নানা প্রার্থনার উত্তর এবং অভিযোগের বিচার চলত।

এসব কাজ চলার সময় নামাজের ওয়াক্ত উপস্থিত হলে মুসলমান প্রজারা সেখানেই শ্রেণীবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়তেন। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে সোজাসুজি পশ্চিমদিকের বদ্ধপ্রাচীরের গায়ে একটি প্রস্তরবেদী ছিল; এর উত্তরদিকে মধ্যখানে আরো দুটি ইষ্টকবেদী ছিল। নামাজের সময়ে ওই বেদীর একটিতে খান জাহান আলী (র), অন্য দুটিতে প্রধান মৌলভীরা দাঁড়াতেন। অন্যান্য সময়ে খান জাহান আলী (র) ও তার উজীর উত্তরদিকের দুটি ইষ্টকবেদীতে সমাসীন হয়ে রাজকার্য নির্বাহ করতেন।

মসজিদটিতে আসলে গম্বুজ রয়েছে ৭০টি। এছাড়াও রয়েছে ৭টি চৌচালা গম্বুজ, যা গম্বুজের প্রকৃত সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। চার কোণায় আরো রয়েছে চারটি মিনার, যাদের মাথায় আবার একটি করে অনুগম্বুজ রয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে মসজিদটিতে প্রকৃত গম্বুজ আছে ৭০টি, আর সবধরনের গম্বুজ যোগ করতে ৮১টি।

অর্থাৎ কোনোভাবেই মসজিদটিতে ৬০টি গম্বুজ নেই। তাহলে এর নাম 'ষাট গম্বুজ' হলো কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে পণ্ডিত ও গবেষকদের কাছ থেকে প্রধান দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

প্রথমত, গম্বুজগুলোর মাঝ বরাবর সাতটি বাংলার স্থাপত্য ধারণার চৌচালা গম্বুজ রয়েছে। অনেকের ধারণা, এই সাত চৌচালা গম্বুজ বা সাত গম্বুজ বিবর্তিত হয়ে ক্রমে ষাট গম্বুজ হয়ে গেছে। আবার অন্য আরেকদলের মতে, মসজিদটি যে ৬০টি পাথরের স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, ফারসি ভাষায় তাকে বলা হয় 'খামবাজ'। আর এ 'খামবাজ' শব্দটি বিবর্তনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে 'গম্বুজ'। অর্থাৎ ৬০টি খাম্বার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটির নাম ষাট খামবাজ থেকে ষাট গম্বুজ।


এর বাইরেও আরেকটি ব্যাখ্যা চাইলে দাঁড় করানো যেতে পারে। মসজিদটিতে কোনো ছাদ নেই। অর্থাৎ আমরা সাধারণত প্রচলিত যে ছাদ দেখি, সে ধরনের কোনো ছাদ এ মসজিদে নেই। অর্ধডিম্বাকার ও আয়তাকার গম্বুজগুলোই এর ছাদ। তাই একে বলা যেতে পারে গম্বুজ আচ্ছাদিত ছাদ। কে জানে, হয়তো গম্বুজ ছাড়া আলাদা ছাদ নেই বলেই এঁকে বলা হতো 'ছাদ গম্বুজ', যার অপভ্রংশ রূপ আজকের ষাট গম্বুজ!

বাগেরহাট জেলার ডেপুটি কমিশনার, মোঃ মামুনুর রশিদ, বর্তমানে ষাট গম্বুজ ও এর আশেপাশের অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ষাট গম্বুজ মসজিদের বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

"মসজিদটি স্বকীয় এ কারণে যে, এর দেয়ালে কিছু হিন্দু মোটিফ খোদাইকৃত আছে, বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা রূপে, এবং এখানে একটি সভ্যতা বাস করত এটি হারিয়ে যাওয়া ও পুনঃআবিষ্কৃত, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে। এবং এখন মসজিদটি ইউনেস্কো হেরিটেজ লিস্টের অংশ।"

খান জাহান আলী (র) নির্মিত অন্যান্য অনেক স্থাপত্যকলায় অনেক পাথরের ব্যবহার দেখা যায়। এত পাথর তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন? ধারণা করা হয়, তিনি আবশ্যকীয় পাথর চট্টগ্রাম হতে আনাতেন। পাঠান আমলে সুন্দরবনের এ অংশ চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাথর আনাতে গিয়ে তার চট্টগ্রামের বায়াজিৎ বোস্তান নামের এক প্রসিদ্ধ বুজরুগ বা অদ্ভূতকর্মা সাধুর সাথে পরিচয় হয়। এই পরিচয় পরবর্তীতে এতটাই ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয় যে, তিনি খলিফাতাবাদ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করেন।

সম্প্রতি এই রাস্তার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃতও হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, বরিশাল-চাঁদপুর হয়ে একদম চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই রাস্তা, যা বর্তমানে 'খান জাহানের প্রাচীন রাস্তা' হিসেবে পরিচিত। যেহেতু পঞ্চদশ শতকের কোনো এক সময়ে এই রাস্তাটি নির্মিত হয়েছিল, তাই ষোড়শ শতকে বাংলার সুলতান শের শাহ সুরির নির্মিত সোনারগাঁও থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত সুদীর্ঘ গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডকে যে এতদিন ধরে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সড়ক বলা হচ্ছিল, এখন তার বদলে খান জাহান আলী (র)-এর এই রাস্তাকেই সবচেয়ে প্রাচীন বিবেচনা করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই প্রাচীন রাস্তাটির রক্ষণাবেক্ষণ করে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে।


১৯১৪ সালে প্রকাশিত সতীশ চন্দ্র মিত্রের লেখা বিখ্যাত 'যশোহর-খুলনার ইতিহাস' বইয়েও প্রাচীন এই রাস্তার উল্লেখ ছিল। সেখানে লেখা হয়েছিল:

"ষাটগুম্বজ হইতে যে রাস্তা পূর্বমুখে বর্তমান বাগেরহাট সহরের দিকে গিয়াছে, ঐ রাস্তাই কাড়াপাড়ার রাস্তা ছাড়াইয়া একটু অগ্রবর্তী হইয়া বাসাবাটী গ্রামের মধ্য দিয়া পুরাতন ভৈরব ও বলেশ্বরের অন্তর্বর্তী প্রদেশ পার হইয়া চলিয়া গিয়াছে। বাগেরহাটের পূর্বদিকে এখন যেমন দড়াটানা প্রবল নদী, তখন সে নদী ছিল না। রাস্তাটি ভৈরবের বাঁকের মাথা দিয়া বৈটপুর, কচুয়া, চিংড়াখালি প্রভৃতি গ্রামের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়া হোগ লাবুনিয়ার নিকট বলেশ্বর পার হইয়া বরিশাল জেলায় প্রবেশ করিয়াছে। তথা হইতে চাঁদপুর পর্যন্ত ঐ রাস্তার বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায় না। কারণ, ঐ প্রদেশের অনেকাংশ নানা বিপ্লবে সমুদ্রগর্ভস্থ ও বিপর্য্যস্ত হইয়াছে। মেঘনার মোহনার সন্নিকটে যে বাঙ্গালা নামক সহর ছিল, যাহার সমৃদ্ধি-গৌরবের কথা মার্কোপলো ও বহু পর্টুগীজ প্রভৃতি ভ্রমণকারী জ্বলন্ত ভাষায় বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহার কোনো নিদর্শন নাই; উহা সম্পূর্ণরূপে ভীষণ সমুদ্রে কুক্ষিগত হইয়াছে। উক্ত রাস্তা দ্বারা 'বাঙ্গালা' নগরীর সহিত খলিফাতাবাদের সম্বন্ধ স্থাপিত হইতেও পারে। যাহা হউক, সেই বিষয় কোন নিশ্চয়তা নাই। তবে চাঁদপুর হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি জঙ্গলাবৃত রাস্তা খাঞ্জালির রাস্তা বলিয়া প্রসিদ্ধ আছে, তাহা আমরা জানি।"

'বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, যশোর' গ্রন্থেও এই রাস্তার উল্লেখ রয়েছে।

এছাড়া সম্প্রতি উদ্ঘাটিত হয়েছে খান জাহান আলী (র)-এর বসতভিটেও। মরগা ও নিকটস্থ সুন্দরঘোনা গ্রামের মাঝামাঝি কোনো স্থানে খান জাহানের বসতভিটে আছে সেটা বহুকাল আগে থেকেই লোকমুখে ছিলো। 'যশোহর-খুলনার ইতিহাস' বইয়েও লেখা ছিল:

"ষাটগুম্বজ হইতে ক্রমে পূর্বমুখে অগ্রসর হইলে আমরা খাঁ জাহান ও তাঁহার সহচরগণের নামীয় নানা কীর্তিচিহ্ন দেখিতে পাইব। ষাটগুম্বজ হইয়ে একটি রাস্তা উত্তরমুখে ভৈরবের কূল পর্যন্ত গিয়াছিল। ওই রাস্তারই পূর্বপার্শ্বে খাঁ জাহানের গড়বেষ্টিত আবাসবাটী ও তাহার সংলগ্ন মসজিদ ছিল। নদীর তীরে গড়বেষ্টিত বাড়ির সদর দ্বার ছিল। বেষ্টনপ্রাচীর ও গড়ের চিহ্ন এখনও আছে।"

কিন্তু ঠিক কোন জায়গাটা যে খান জাহান আলী (র)-র বসতভিটে, তা কোনোভাবেই নির্ধারণ করা যাচ্ছিল না। শেষমেশ ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে মরগার ওই ঢিবি থেকে ইট, স্থাপনায় ব্যবহৃত অন্যান্য সরঞ্জামের খণ্ড খণ্ড বেরিয়ে আসতে থাকায় স্থানীয়রা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর সমীক্ষা চালিয়ে বোঝা যায়, এখানেই ছিলো খান জাহান আলী (র)-এর বসত ভিটে।


নানা প্রক্রিয়ার পর ২০০১ সালে প্রথম এখানে খনন কাজ শুরু হয়। এরপর ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর কাজ চলতে থাকে। প্রতিবারই খনন করে নতুন নতুন দ্রব্য-সরঞ্জাম উদ্ধার করা হতে থাকে।



প্রাচীন খলিফাতাবাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, প্রত্নস্থলে শঙ্খসহ এমন কিছু জিনিস পাওয়া গেছে, যাতে মনে হচ্ছে বড় কোনো জলোচ্ছ্বাসের ফলে খলিফাতাবাদ পুরো ধ্বংসের কবলে পড়ে। খান জাহান আলী (র) নিঃসন্তান ছিলেন বলে পরে তার বসতভিটের খোঁজও কেউ রাখেনি।

অনেকেরই ধারণা, খান জাহান আলী এসে খলিফাতাবাদের গোড়াপত্তনের আগে হয়তো এ অঞ্চলে কোনো লোকবসতিই ছিল না। তবে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও পুরনো দলিল থেকে যতদূর বোঝা যায়, পঞ্চদশ শতকে সমৃদ্ধ ইসলামি ঐতিহ্য গড়ে ওঠার আগেও বাগেরহাটের প্রাচীন ভিত্তি ছিল। এ প্রসঙ্গে টিম স্টিল বলেন:

"এটি না হলেই বরং অবাক হতে হবে। ম্যানগ্রোভ বনটির (সুন্দরবন) ব্যাপারে খুব ভালোভাবেই অবগত ছিলেন প্রাচীনকালের বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটক ও বণিকরা। তাছাড়া এটি একদম প্রান্তঘেঁষে অবস্থিত ছিল একটি দারুণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের, যার অস্তিত্বের প্রমাণ আমরা পাই, অন্তত খ্রিস্টপূর্ব শেষ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে।"

বাগেরহাটে এমন কিছু প্রামাণ্য নিদর্শনও পাওয়া যায়। যেমন: বাগেরহাটের অতিপ্রাচীন স্থান পানিঘাটে প্রাপ্ত কষ্টিপাথরের অষ্টাদশভুজা দেবীমূর্তি, চিতলমারী উপজেলাধীন খরমখালি গ্রামে পাওয়া কৃষ্ণপ্রস্তরের বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি নিদর্শন এখানে হিন্দু সভ্যতার পরিচয় বহন করে। এছাড়া মরগা খালের তীরে খান জাহান আলী (র)-এর পাথরভর্তি জাহাজ ভেড়ার স্থান জাহাজঘাটায় মাটিতে গ্রোথিত পাথরে উৎকীর্ণ অষ্টাদশভুজা মহিষ মর্দিনী দেবীমূর্তির নিদর্শনও রয়েছে।








'যশোহর-খুলনার ইতিহাস' বইয়েও খান জাহান আলী (র) কর্তৃক খলিফাতাবাদ নগরী স্থাপনের পূর্বে এখানে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ নগরীর ধ্বংসাবশেষ থাকার কথা বলা হয়েছিল।

"একটি প্রাচীন বৌদ্ধ নগরীর ধ্বংসাবশেষের সাহায্যে খাঁ জাহান স্বকীয় সহর গঠন সম্পন্ন করিয়াছিলেন। ষাটগুম্বজ হইতে জাহাজঘাটা পর্যন্ত যে রাস্তা গিয়াছে, উহারই উভয় পার্শ্বে নানা বৌদ্ধকীর্তি ছিল, এই জন্য এইস্থানেই প্রথম সহর প্রতিষ্ঠার কল্পনা করা হয়। জাহাজঘাটার প্রস্তরস্তম্ভ যে কোন পুরাতন হিন্দুমন্দিরের অংশবিশেষ তাহা পূর্বে দেখাইয়াছি। উহার গাত্রে একটি অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী দেবীমূর্তি ছিল বলিয়াই খাঁ জাহান এই স্তম্ভটিকে কোন অট্টালিকা নির্মাণে প্রয়োগ করেন নাই; যেগুলির গাত্রে এমন পরিস্ফুট মূর্তি অঙ্কিত ছিল না বা যাহার মূর্তিচিহ্ন সহজে বিলুপ্ত করা গিয়াছিল, তাহাই দিয়াই তিনি নিজের বাড়ি বা ষাটগুম্বজ নামক দরবারগৃহ নির্মাণ করিয়াছিলেন। তাহা হইলেও তিনি যে সমস্তই পরের পাথর লইয়া কার্য করিয়াছিলেন, তাহা নহে। তাহাঁর আবশ্যকমত সমস্ত পাথরই যে সেখানে সঞ্চিত ছিল, এমন হইতেও পারে না। স্তম্ভ ব্যতীত অন্য পাথরেরও তিনি যথেষ্ট ব্যবহার করিয়াছেন। তাহাঁর সমাধিগৃহের ভিত্তিমূল হইতে মাটির উপর তিন ফুট পর্যন্ত সমস্তই পাথরে গঠিত। এ সকল পাথর কোথা হইতে আসিল?"

এই প্রশ্নের উত্তর আমরা আগেই দিয়েছি: চট্টগ্রাম থেকে পাথর আনিয়েছিলেন তিনি। তবে এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় খান জাহান আলী (র) আগমনের পূর্বে এ অঞ্চলে অন্য কোনো সভ্যতা ছিল কি না। কথিত আছে, খাঞ্জেলির দীঘি খনন করার সময় একটি অনন্য সাধারণ আবক্ষ ধ্যানী বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়, যা এ অঞ্চলে বৌদ্ধ প্রভাবের পরিচয়ও বহন করে।

যা-ই হোক, খান জাহান আলী (র)-এর মাজারগাত্রে উৎকীর্ণ শীলালিপি হতে জানা যায়, ২৬ জিলহজ্ব ৮৬৩ হিজরী তথা ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর হুসেন শাহী রাজবংশের শাসকরা (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) এ অঞ্চল শাসন করতেন। অনেকে মনে করেন বাংলার সুলতান নুসরাত শাহ টাকশাল বাগেরহাট শহরের নিকটবর্তী মিঠাপুকুরের নিকটে অবস্থিত ছিল। উল্লেখ্য, মিঠাপুকুর পাড়ে সে আমলের একটি মসজিদ আছে।

এদিকে খান হাজান আলী (র)-এর মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত, তথাকথিত 'মসজিদের শহর বাগেরহাট' অর্থাৎ খলিফাতাবাদ নগরী জঙ্গলে ঢেকে যায়। এরও শত বছর পরে পুনরায় এটি আবিষ্কৃত হয়, এবং এর নতুন নাম হয় বাগেরহাট।


ইংরেজ শাসনামলে বাগেরহাট প্রথমে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে সরাসরি ব্রিটিশরাজের অধীনে চলে যায়। ১৭৮৬ সাল লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে যশোরকে জেলায় পরিণত করা হয়।

ইংরেজদের অধিকারে আসার পর, এই অঞ্চল প্রথমে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিসের শাসন আমলে যশোরকে জেলায় পরিণত করা হয়। ১৮৪২ সালে খুলনা যখন যশোর জেলার একটি মহকুমা, তখন বাগেরহাট খুলনার অন্তর্গত একটি থানা। ১৮৪৯ সালে মোড়েল উপাধিধারী দুজন ইংরেজ বাগেরহাটে মোড়েলগঞ্জ নামক একটি বন্দর স্থাপন করেন। এর বছর দুয়েক বাদে, ১৮৬১ সালের ২৬ নভেম্বর 'মোড়েল-রহিমুল্লাহ' নামে খ্যাত এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (নীল বিদ্রোহ) হয়।







তখন খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এ সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশাসনিক প্রয়োজনে বাগেরহাটে একটি পৃথক মহকুমা স্থাপনের সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশের সূত্র ধরে ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট যশোর জেলার অন্তর্গত একটু মহকুমায় রূপান্তরিত হয়। ১৮৮২ সালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহকুমা নিয়ে নতুন করে গঠিত হয় খুলনা জেলা। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাগেরহাটেরও ছিল বিশেষ ভূমিকা। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা শহরে এবং পরের তিন দিন সারা দেশে হরতালের ডাক দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে ৩ মার্চ থেকে হরতাল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খুলনা শহরে ২ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত টানা পাঁচদিন হরতাল পালিত হয়েছিল। এ হরতাল চলাকালে খুলনায় ৩ মার্চ সাতজন এবং ৪ মার্চ আরো তিনজন প্রাণ হারায়। এর প্রতিবাদে খুলনা জেলার তৎকালীন মহকুমা শহর বাগেরহাটও হয়ে উঠেছিল উত্তাল। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে সমগ্র দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধের অলিখিত ঘোষণা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল না বাগেরহাটও। তারাও শুরু করে দিয়েছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি। ৯ মার্চই গঠিত হয় 'বাগেরহাট মহকুমা সংগ্রাম কমিটি', যার অংশ ছিল স্বাধীনতার পক্ষের সবগুলো দল।







২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৩০ মার্চ বাগেরহাটে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভা। ৭ এপ্রিল মেজর এম এ জলিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য বাগেরহাট আসেন। পরদিন তৎকালীন বাগেরহাট পৌরপার্কে (বর্তমান স্বাধীনতা উদ্যান) এক জনসভা অনু্ষ্ঠিত হয়। আর ১১ এপ্রিল পাক সেনাবাহিনীর ৯ জন বাঙালি সদস্য সুবেদার মুজিবের নেতৃ্ত্বে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বাগেরহাটে উপস্থিত হয়ে সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন। একই সময়ে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র নেতাও বাগেরহাটে এসে সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাট ছিল ৯ নং সেক্টরের অধীনে। এ শহরের কুখ্যাত রাজাকার ছিল রজব আলী ফকির। তার নেতৃত্বে বাগেরহাটে একটি সুগঠিত রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল থেকে পাক হানাদার আর রাজাকারদের মিলিত প্রচেষ্টায় বাগেরহাটে গণহত্যার সূচনা হয়েছিলো। ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ছোট-বড় অর্ধশতাধিক গণহত্যার ঘটনা ঘটে সমগ্র বাগেরহাট মহকুমায়। এ সময়ে বাগেরহাটের বহু সাধারণ মানুষ ভারতে পালিয়ে যায়।

কথিত আছে, রাজাকার-আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ কে এম ইউসুফের জন্মস্থান বাগেরহাটে হওয়ায়, ১৬ ডিসেম্বরও বাগেরহাট শহরের নিয়ন্ত্রণ ছিল রাজাকার বাহিনীর কাছে। তবে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে বাগেরহাট এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অন্যতম নেতা রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে 'রফিক বাহিনী' শহরের মুনিগঞ্জ এলাকা দিয়ে এবং ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে 'তাজুল বাহিনী' শহরের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে মেজর জিয়া উদ্দিনের বাহিনী সম্মিলিতভাবে বাগেরহাট শহর দখলের জন্য আক্রমন করলে রাজাকার-আল বদর-পাকিস্তানি বাহিনী হার মানতে বাধ্য হয়। ফলে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে বাগেরহাট।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। বর্তমানে বাগেরহাট ৯টি উপজেলা, ৭৫টি ইউনিয়ন, ১০৪৭টি গ্রাম এবং ৩টি পৌরসভার সমন্বয়ে গঠিত একটি 'এ' ক্যাটাগরিভুক্ত জেলা।



Photo: অযোদ্ধার মঠ



নিঃসন্দেহে বর্তমান বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খান জাহান আলী (র)-এর মাজারের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও সুন্দরবন, মংলা বন্দর, খান জাহান আলী সেতু তো রয়েছেই, এ শহরের রয়েছে আরো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। যেমন: সিঙ্গাইর মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, জিন্দা পীর মসজিদ, ঠান্ডা পীর মসজিদ, বিবি বেগুনি মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ, দশ গম্বুজ মসজিদ, অযোধ্যা মঠ বা কোদলা মঠ, দুর্গাপুর শিবমঠ, সাবেকডাঙ্গা মনুমেন্ট ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, মসজিদের এই শহরেই অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা। ২০১০ সালে বাগেরহাট সদর উপজেলার হাকিমপুর গ্রামের বাসিন্দা, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লিটন শিকদার ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বাড়িতে প্রথমবারের মতো দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। ওই সময় ১৫১টি প্রতিমা তৈরি করে তিনি সবার নজরে আসেন। এরপর থেকে প্রতিবছরই এই মণ্ডপে প্রতিমার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যেমন- ২০১৯ সালে এই মণ্ডপে ৮০১টি প্রতিমা নিয়ে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আয়োজকরা একে "পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্গাপূজা" হিসেবেও দাবি করে থাকেন।







সব মিলিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার, ঐতিহাসিক নিদর্শনে ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাগেরহাট বর্তমানেও কোনো অংশে কম যায় না। তাই এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হবে, এমন আশা করাও বোধহয় বাড়াবাড়ি নয়। কিন্তু বাস্তবে কি সেই আশার প্রতিফলন ঘটছে? ঘটছে না। প্রতি বছর কক্সবাজার, সেইন্ট মার্টিন কিংবা সিলেট, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, সাজেকে যে পরিমাণ দর্শনার্থীর ভিড় হয়, বাগেরহাটে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না।

এর সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে? বাগেরহাটে সমুদ্রও নেই, পাহাড়ও নেই, এ কথা যেমন সত্য, তেমন বাগেরহাটে যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর পাশাপাশি সমুদ্র বন্দর আছে, সুন্দরবন আছে, এগুলোও তো ভুলে গেলে চলবে না। তাই একটি কারণ অবশ্যই প্রশাসনের ব্যর্থতা বাগেরহাটকে একটি সর্বোচ্চ মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা।



বাংলাদেশের এক ছোট প্রান্তে অবস্থিত বাগেরহাট আপনাকে নিয়ে যাবে এক স্থাপত্য ভ্রমণে। কিংবা একে কোনো পুরনো বইয়ের একটি দীর্ঘ-বিস্মৃত পাতাও বলতে পারেন আপনি। এই জায়গাটি আপনাকে অনুধাবন করাবে, যদি অনাবিষ্কৃত থাকত তবে কী জিনিসই না আপনি হারাতেন!"

#Thestoryofthelostcityof #Bagerhat#sixtydomemosque


© Durbar Bagerhat

Comments

Popular posts from this blog

Google I/O 2025: What to Expect - AI, Android, Pixel & Beyond!

Google I/O 2025: Peering into the Future – AI, Android 16, Pixel & Beyond! Google I/O 2025: What to Expect - AI, Android, Pixel & Beyond! The tech world thrives on anticipation, and few events stir up quite as much excitement as Google I/O. While the dust may have just settled (or is about to settle) on I/O 2024, true tech aficionados are already casting their gazes further, towards  Google I/O 2025 . This annual developer conference is Google’s prime stage to unveil its latest software breakthroughs, hardware innovations, and the overarching vision for its vast ecosystem. So, grab your virtual crystal ball as we dive deep into what Google might have in store for us at  Google I/O 2025 . This is pure speculation, of course, based on current trends, Google’s trajectory, and a healthy dose of informed guesswork. But isn’t that half the fun? What Exactly IS Google I/O? A Quick Refresher For the uninitiated, Google I/O (Input/Output) is more than just a series ...

CHATGPT‑5 is here: Features, use cases, and how to get started

GPT‑5 is here: Features, use cases, and how to get started Meta description: GPT‑5 is here. Explore what’s new, key features, real‑world use cases, and tips to get started with the next generation of AI. TL;DR GPT‑5 brings stronger reasoning, native multimodality, longer context, and faster, more reliable tool use. Ideal for creators, developers, researchers, marketers, educators, and customer support teams . Jump in with clear goals, structured prompts, and responsible workflows to get the most out of it. What is GPT‑5? GPT‑5 is the next leap in large‑scale AI—designed to understand, reason, and create across text and other modalities. It aims to be more accurate, context‑aware, and adaptable than earlier generations, making it a powerful companion for complex tasks, from strategy and research to production‑grade content and code. What’s new in GPT‑5 vs GPT‑4? Area GPT‑4 (previous gen) GPT‑5 (current gen) Reasoning Strong general reasoning More robust multi‑step and domai...

The Untold Story: Why Did the Canadian Prime Minister's Family Break Up?

The Untold Story: Why Did the Canadian Prime Minister's Family Break Up? Discover the untold story behind the breakup of the Canadian Prime Minister's family in this intriguing article. Uncover the reasons and secrets that led to their separation. The breakup of the Canadian Prime Minister's family has been a topic of intrigue and speculation. In this article, we delve into the untold story behind their separation, uncovering the reasons and secrets that led to the end of their relationship. Introduction to the Canadian Prime Minister's family. The Canadian Prime Minister's family has always been in the spotlight, with their every move and decision scrutinized by the public. However, behind the scenes, there were hidden tensions and conflicts that eventually led to their breakup. In this article, we will provide an introduction to the Prime Minister's family, shedding light on their dynamics and the events that ultimately led to their separation. Sig...