"ছাত্র রাজনীতির ঐক্যে ছাত্রলীগের দায়ভার

আফরিন নুসরাত

এটা সবাই জানেন, ছাত্রলীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শুধু ছাত্রসংগঠনই নয়, একই সঙ্গে সবচেয়ে নিকটতম আদর্শিক বন্ধুপ্রতিম সংগঠনও। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠন সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস’। অথচ কষ্ট হয় যখন দেখি, বিভিন্ন সময়ে এই সংগঠনটি তাদের নৈতিক ও কর্তব্যবোধ থেকে দূরে সরে গিয়ে জ্ঞানশূন্যতায় ভোগে। অগ্রজ আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, তখন ছাত্রলীগের দায়িত্ববোধে যে জড়তা দেখা যায়, তা অনেকের মতো আমাকেও হতাশ করে।
‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে তুলনা করা যেতে পারে একটা আদর্শিক রাজনৈতিক ‘স্কুল’ হিসেবে, যা বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্কুলের চত্বর পেরিয়েছে ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-তে আইয়ুব খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিরোধ, ৬৬'র ছয় দফা বাস্তবায়ন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ ছাড়াও হাজারো আন্দোলন। স্বাধীনতা উত্তর প্রতিটা আন্দোলনের নেতৃত্বেই ছিল ছাত্রলীগ। জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত বর্তমান ছাত্রলীগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকায় একজন সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমার দায়বদ্ধতার কথাটিই প্রথমে স্মরণে আসে। আর সেই বোধ থেকেই কিছু কথা বলা।
ছাত্রলীগের গোড়াপত্তন হয়েছিল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যার সিংহভাগ সময়ই অতিবাহিত হয়েছে বিভিন্ন সফল সংগ্রামের পথ ধরে। সুতরাং যৌক্তিক কারণেই দলটির মনস্তাত্ত্বিক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের একরোখা সরু পথ ধরে। বিরোধী দলে থেকে ছাত্রলীগ রাজনীতিতে যতটা সহজাত স্বাচ্ছন্দবোধ করে, ততটা করে না যখন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে। তখন স্বভাবতই সংগঠনে দেখা দেয় এক ধরনের স্থবিরতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ আন্দোলনের জায়গা খুঁজে পায় না। তাই দুঃখজনকভাবে ছাত্রলীগের কার্যক্রম ছকবাঁধা কিছু সভা-সেমিনার আর বিশাল বিশাল কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। মাঝে মাঝে দুই একটা ফলদায়ক কার্যক্রম যে হতে দেখা যায় না, তা নয়। তবে তাও নিতান্ত লোক দেখানো, দায়সারা গোছের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। সংস্কৃতি চর্চা বিমুখ ছাত্রলীগের মুক্তচিন্তার অনুশীলনও যেন আজ মহাকালের অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়- যে সময়ে ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েদের গান-কবিতা-প্রেম-দ্রোহের মনস্তাত্ত্বিক চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, সেই সময়ে অনেকেই পড়ে যাচ্ছেন হতাশার কালো আঁধারের আস্তাকুড়ে। অনেকে জড়িয়ে পড়েন টেন্ডারবাজী সহ নানান ধরনের অপরাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে।

প্রথাগত বিরোধী দলের ভাবাদর্শীক রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন হিসেবে পথচলার মানষিক চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ছাত্রলীগকে। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন ছাত্রলীগের কার্যক্রম ও চর্চায় আনতে হবে আধুনিকতা ও ভিন্নতার ছাপ। রাজনীতির ভাবাদর্শকে রূপান্তরিত (Convert) করতে হবে উন্নয়নশীল, প্রগতিধারার রাজনীতিতে। শুধু তখনই তা হবে ইতিবাচক, জনকল্যানমুখী ও সরকারবান্ধব রাজনীতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশ গড়তে দৃঢ় প্রত্যয়ী। এ প্রত্যয়ে বাঁধ সাধছে একাত্তরের হায়নারা। জামায়াত-বিএনপির ছত্রছায়ায় ও চক্রান্তে দেশ আজ জঙ্গিবাদের ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত। এই দানবীয় ভাইরাসকে রুখতে হবে।

এটা সত্যি যে, সরকারের বন্ধুপ্রতীম ছাত্রসংগঠন হিসেবে জঙ্গিবাদ দমনের দায়ভার শুধু ছাত্রলীগের একার নয় এবং তা অনেকাংশে সম্ভবও নয়। জঙ্গিবাদ দমন প্রশ্নে একাত্তরের পক্ষের প্রগতিশীল অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলো কি দায় এড়াতে পারেন! আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জঙ্গি ও মৌলবাদের কালো থাবায় শুধু ছাত্রলীগের একার ঘরই অন্ধকার হবে না। তা গ্রাস করবে একাত্তরের পক্ষের প্রতিটি ঘরকেই। ছাত্রলীগের উচিত হবে জঙ্গি ও মৌলবাদ দমনে সমমনা স্বাধীনতার পক্ষের সব ছাত্রসংগঠনগুলোকেই কাছে টানা। আদর্শিক মোটা দাগের কৌশলগত দলীয় পার্থক্যগুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে, অভিন্ন জাতীয় ইস্যুগুলোতে একসঙ্গে হয়ে কাজ করা। জঙ্গিবাদ দমনের প্রত্যয়ে প্রতিটি জেলার তৃণমূল পর্যায়ে গড়ে তুলতে হবে সম্মিলিত শক্তিশালী গণ-প্রতিরোধ ইউনিট।

জাতীয় স্বার্থে, মতপার্থক্যকে বড় করে না দেখে, সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে শত্রু প্রতিরোধে, ঠিক একাত্তরের মতো করে। গুড়িয়ে দিয়ে হবে একাত্তরের কালো হাত। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, ‘ভূমিকম্পে শুধু অন্যের পায়ের নিচের মাটিই কাঁপে না, আমার মাটিও কাঁপে’। শুধু এ বিশ্বাস থেকেই সম্ভব পারস্পরিক সম্পর্কের সম্মিলন ঘটিয়ে ‘হায়না-প্রতিরোধ’ মোর্চা তৈরি করা। তা নাহলে মৌলবাদের এই আবর্জনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর বয়ে বেড়াতে হবে এ জাতিকে। শুধু জঙ্গি ও মৌলবাদই নয়; জাতীর যে কোনও ক্রান্তিলগ্নেই ছাত্রলীগের উচিত অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করা। ইস্যুভিত্তিক রাজনীতিতে একতাই শক্তি। এর ব্যত্যয়ে শত্রুশিবিরেই জ্বলবে জয়ের আলো।

কিশোর মনস্তত্ত্বের সুস্থ্য বিকাশের জন্য ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিটের অফিসগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। পার্টি অফিসের আদলে সেখানে থাকবে সুসজ্জিত লাইব্রেরি। কিশোর ছেলেমেয়েদের সেখানে বিনামূল্যে পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। উদ্বিগ্ন বাবা-মা যখন দেখবেন তাদের সন্তানেরা পড়ছে, খেলাধুলা করছে, চিন্তার সুস্থ্য বিকাশ ঘটাচ্ছে, তখন ছাত্রলীগের প্রতিও তাদের আস্থার ভিত মজবুত হবে। ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটি আজ কিছুটা নড়বড়ে। এটাকে ঠিক করে আবার সেই আস্থার জায়গায় ফিরে যাওয়াই হতে হবে ছাত্রলীগের অধুনা-নৈতিক সংগ্রাম।

বই মানুষকে আলোকিত করে, মনের দরজাগুলো খুলে দেয়। বই পড়ার অভ্যস্ততা আজকাল ছেলেমেয়েদের মাঝে বিলুপ্ত প্রায়। অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলোর ভেতরে হয়ত বই পড়ার অভ্যাস কিছুটা বেশি। তাদের অনুকরণ করতে বা সহায়তা নিতে দোষ কোথায়! ভালো কাজের অনুকরণ নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য। মন্দ কাজকে ত্যাগ করাইতো সভ্যতা! সুস্থ্য সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি দলীয় বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের বই পড়ার প্রতি আহবান জানাতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, বিজ্ঞানশিক্ষার আলোকে অভ্যস্ত যারা, তাদের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত করা অসম্ভব প্রায়। পড়ার পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মকে বাংলার চিরায়িত সংস্কৃতি চর্চায়ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জারি, সারি, বাউল গান আমাদের লোকসংস্কৃতির আলোকধারা। এগুলোর সাথে তরুণ্যকে পরিচিত ও সম্পৃক্ত করার প্রত্যয়ই হোক আধুনিক ছাত্রলীগের আন্দোলন ও সংগ্রামের বিকাশধারা।

হাজার বছর ধরে আমাদের ভূখণ্ড অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার লালন করে আসছে। যে দেশ বাউলের, যে দেশ ভাটিয়ালির, যে দেশ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সহ সকল ধর্মের মানুষের, সেদেশ জঙ্গিবাদের আশ্রয়স্থল হতে পারে না। পৃথিবীতে সম্প্রীতির দেশ হিসেবে খ্যাত আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। এদেশ আফগানিস্তান বা পাকিস্তান নয় যে, চাইলেই জঙ্গিবাদের আখড়া খুলে বসা যাবে। যদি কেউ চায়, তাহলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে তা শক্ত হাতে দমন করতে হবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এই মহতি উদ্দেশ্যের পাশে অন্যান্য প্রগতিশীল, একাত্তরের পক্ষের ছাত্রসংগঠনগুলোও থাকবে বলেই আমার আশাবাদ। আর কোনও নিবরাস যাতে বিপথগামী না হয়, সেই প্রচেষ্টাই হোক ছাত্রলীগের সংগ্রামী ব্রত! অন্যান্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এসংগ্রামের অগ্রসেনানীর ভূমিকায় থাকুক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এ চাওয়াটুকু বোধকরি নিশ্চয়ই আমার অতি-প্রত্যাশিত নয়!

লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

Comments

Popular posts from this blog

Once Again Sheikh Hasina

The Bright Future of Bangladesh with Sheikh Hasina

Meta AI Systems that Generate Images